source:lithub.com
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তাঁর সৌন্দর্য, উন্নত রুচিবোধ ও শিক্ষার মাধ্যমে মুঘল
রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে
সিংহাসনের পেছনের মূল শক্তি মনে করা হয় নূরজাহানকে।
তিনি তাঁর সৌন্দর্য,সুগন্ধি তৈরি,নকশা করা পোশাক তৈরি,শিকারের দক্ষতা ও
সর্বোপরি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মাধ্যমে মুঘল ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছেন।
পরিচয় ঃ
জন্মঃ ৩১ মে ১৫৭৭
স্থানঃকান্দাহার(বর্তমান আফগানিস্তান)
পূর্ণ নামঃ মেহের-উন-নিসা
পিতাঃ মির্জা গিয়াস বেগ
মাতাঃ আসমত বেগম
মৃত্যু ঃ ১৭ ডিসেম্বর ১৬৪৫
লাহোর(বর্তমান পাকিস্তান)
নূরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ছিলেন ইরানের তেহরান শহরের সম্ভ্রান্ত
পরিবারের সন্তান। গিয়াস বেগ তাঁর পিতার মৃত্যুর পর এবং সাফাভিদ রাজবংশের
অসহিষ্ণুতার কারণে তেহরান থেকে সস্ত্রীক দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন।পথিমধ্যে
তার স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। ১৫৭৭ সালে জন্ম নেয়া সেই শিশুটির
নাম রাখা হয় মেহের-উন-নিসা।তিনিই পরবর্তী কালের ভারত সম্রাজ্ঞী নূরজাহান।
সম্রাট জাহাঙ্গীরই তাকে নূরজাহান নাম দেন।
মুঘল দরবারে স্থান লাভঃ
তেহরান থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে মেহেরুন্নিসার জন্মের পর তাঁর পিতা-মাতা বিপদে
পড়ে যান।বিপদাপন্ন পরিবারটিকে সাহায্য করেন দিল্লিগামী কাফেলার দলপতি মালিক
মাসুদ। মালিক মাসুদের মাধ্যমে গিয়াস বেগ সম্রাট আকবরের দরবারে স্থান লাভ করেন
এবং পরবর্তীতে দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত হন।পিতার মাধ্যমেই মেহেরুন্নিসা মুঘল
দরবারে প্রবেশের সুযোগ পান।মায়ের সঙ্গে তাঁর ও স্থান হয় মুঘল হেরেমে।
বিয়ে ঃ
মেহেরুন্নিসার দুজন স্বামীর কথা জানা যায়। তাদের একজন আলী কুলী ইসতাজলু,অন্যজন
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর।
প্রথম বিয়ে ঃ
শোনা যায় হেরেমে মেহেরুন্নিসাকে দেখতে পেয়ে যুবরাজ সেলিমের(জাহাঙ্গীর) পছন্দ
হয়ে যায় এবং বিয়ের জন্যে অস্থির হয়ে ওঠেন।কিন্তু সম্রাট আকবরের কানে এই সংবাদ
পৌঁছালে তিনি বংশ মর্যাদার কথা ভেবে এই বিয়েতে অসম্মতি জানান। আকবর তড়িঘড়ি করে
মেহেরুন্নিসাকে আফগান বংশীয় সাহসী ও সচ্চরিত্র যুবক আলী কুলীর সঙ্গে ১৫৯৪ সালে
বিয়ে দিয়ে দেন।তখন মেহেরের বয়স ছিল ১৭ বছর। বিয়ের পর তাদের বর্ধমানে পাঠিয়ে
দেওয়া হয়।পরবর্তীতে সেলিম সম্রাট হয়ে জাহাঙ্গীর নাম ধারণ।জাহাঙ্গীরের প্রতি
আনুগত্যহীনতার কারণে আলী কুলীর সাথে জাহাঙ্গীরের বিরোধ দেখা দেয়।১৬০৬ সালে
কুতুবউদ্দিনের সাথে যুদ্ধে আলী কুলী নিহত হন।ইতোমধ্যে মেহেরুন্নিসা একটি কন্যা
সন্তানের জন্ম দেয়। কন্যা লাডলী বেগম সহ তাকে বন্দী করে আগ্রার কারাগারে
পাঠানো হয়।মেহের আকবরের স্ত্রীর দেখাশোনার দায়িত্ব পান।
সম্রাটের সাথে বিয়ে ঃ
মনে করা হয় মেহের-উন-নিসার প্রতি সম্রাটের আগে থেকেই আকর্ষণ ছিল।১৬১১ সালের ২১
মে সন্ধ্যায় শাহী মহলের মীনা বাজারে বর্ষবরণের নওরোজ উৎসবে সম্রাট আবার
মেহেরুন্নিসাকে দেখতে পান এবং তৎক্ষণাৎ বিয়ের প্রস্তাব দেন।তবে অনেক
ঐতিহাসিকের ধারণা এই মীনা বাজারেই সম্রাট প্রথম মেহেরুন্নিসাকে দেখতে পান।
যাইহোক ১৫১১ সালের ২৫ মে তারিখে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে বিয়ে করেন।স্ত্রীর রুপে
মুগ্ধ হয়ে সম্রাট প্রথমে তাকে নূরমহল(মহলের আলো) এবং ৫ বছর পরে নূরজাহান(জগতের
আলো) উপাধি দেন। সত্যিসত্যিই তিনি তাঁর শিক্ষা,মননশীলতা,সাহসিকতা, দক্ষতা
দ্বারা সমগ্র জগৎকে আলোকিত করেছেন।
জাহাঙ্গীরের সাথে পূর্ব প্রণয়ের কারণে স্বামী আলী কুলীকে হত্যায় তিনি সাহায্য
করেছেন বা জাহাঙ্গীর হত্যা করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।তবে আকবর
জাহাঙ্গীরের সাথে মেহেরুন্নিসার বিয়ে দিতে সম্মত হননি এটি আবুল ফজলের লেখা
থেকে স্পষ্ট জানা যায়।
মুঘল রাজনীতি ও সম্রাটের উপর নূরজাহানের প্রভাবঃ
"আমার রাজ্য আমি এক পেয়ালা মদ আর এক বাটি সুরার বিনিময়ে আমার প্রিয় রাণীর কাছে
বেচে দিয়েছি।"
সম্রাট জাহাঙ্গীরের এমন উক্তি দ্বারা খুব সহজেই বোঝা যায় নূরজাহানের উপর তিনি
কতটা নির্ভরশীল ছিলেন।অনেকের ধারণা সম্রাট অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন এবং আফিমের
নেশার কারণে তিনি রাজকার্যে মনোযোগ দিতে পারতেন না।সেই সুযোগে উচ্চাভিলাষী
নূরজাহান রাজক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন।নূরজাহান সম্রাটের ২০
তম এবং সর্বাপেক্ষা প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে তিনি নিজ থেকেই
তার মতামত ব্যক্ত করতেন।মার্জিত, শিক্ষিত, বিচক্ষণ এই নারী স্বামীর সঙ্গে
রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করতেন।
সম্রাটের উপর তার এতই প্রভাব ছিল যে জাহাঙ্গীরের শাসনামলকে "petticoat
government " বলা হয়।নূরজাহান যেমন ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্যের অধিকারী তেমন ছিল
তাঁর রুপের মাধুর্য। যার কারণে সম্রাট তাকে অধিক ভালোবাসতেন এবং তার পরিপূরক
হিসেবে রাজ দরবারে কোনো বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহনেও আপত্তি করেন নি।
সম্রাট সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্ত্রীর উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন এমন নয়,মূলত তারা একে
অপরের পরিপূরক হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
সম্রাটের সাথে বিয়ের পরপরই রাজদরবারে তাঁর উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেন।
১৬১৩ সালে তিনি 'পাদশাহ বেগম ' উপাধি লাভ করেন। তাঁর পিতা গিয়াস বেগ, ভাই আসফ
খানসহ আত্নীয়রা রাজদরবার উচ্চ পদ লাভ করেন। তিনি ঝরোকা দর্শনে( প্রত্যহ সকালে
দরবারে উপস্থিত হওয়া)সম্রাটের সাথে উপস্থিত হতেন। এছাড়া তাঁর নামে মুদ্রা
খোদিত হয়,সম্রাটের নামে ফরমান ও স্বাক্ষর করতে শুরু করেন। তিনি শিকারেও
অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন,বড় বড় প্রাসাদের নকশা প্রণয়নেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর
নির্দেশ মন্ত্রী এবং সভাসদগণ অমান্য করতে পারতেন না।এমনকি তাঁর প্রতিকৃতি
সম্রাটের সাথে মুদ্রায় অঙ্কিত হয়।তিনি বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশনেবল পোশাক,
সুগন্ধি, অলঙ্কারাদি তৈরিতে অবদান রাখেন।অনাথের আশ্রয় দান এবং অনাথ বালিকাদের
বিবাহের ব্যবস্হা করতেন।তিনি স্বামীর সাথে একবার ৬ টি গুলিতে ৪ টি বাঘ বধ করেন
বলে জানা যায়।
রাজক্ষমতা গ্রহনের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর কন্যা লাডলী বেগমকে ১৬২১ সালে
জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারের সাথে বিয়ে দেন।১৬২২ সালে শাহরিয়ারের
ভাই খুররমকে কান্দাহার দুর্গ দখলের জন্য নির্দেশ দেন
যাতে সুযোগে শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসাতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি বুঝতে পেরে খুররম
কান্দাহারে না গিয়ে বিদ্রোহ করে বসেন। জাহাঙ্গীর মহব্বত খানকে বিদ্রোহ দমন
করতে পাঠান। কিন্তু আসফ খানের প্ররোচনায় তিনিও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং
জাহাঙ্গীরকে বন্দী করেন। খুররম নিজ ভাই শাহরিয়ারকে হত্যা করে শাহজাহান নাম
নিয়ে সিংহাসনে বসেন।নূরজাহানকে বন্দী করেন। পরবর্তী ১৮ বছর সম্রাজ্ঞী নূরজাহান
বন্দী অবস্হাতেই কাটান।
এসময় তিনি 'মাখফি' নামে পারসিক কাব্য রচনা করেন। এছাড়া বাগান করা,পিতা-মাতার
সমাধি নির্মাণ তত্ত্বাবধান করে সময় অতিক্রম করেন।
শেষজীবনঃ
এভাবে দীর্ঘ ১৮ বছর বন্দীদশায় থেকে প্রভাবশালী এই মুঘল সম্রাজ্ঞী ১৬৪৫ সালে
লাহোরে মারা যান। তার সমাধি লাহোরের শাহদারা বাগে।
মুঘল আমলের প্রকৃত সম্রাজ্ঞী হলেন নূরজাহান।তার মত সকল ক্ষেত্রে কেউ প্রভাব
রাখতে পারেন নি।
তবে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে ভাই মহব্বত খান,জাহাঙ্গীরের পুত্র খুররমের
বিদ্রোহ সহ নানা অরাজকতার সৃষ্টি হলেও তাঁর মত মহীয়সী, বিচক্ষণ, মার্জিত,
শিক্ষিত নারী মুঘল ইতিহাসে পূর্বে দেখা যায় নি।তাঁর প্রভাব শুধু সম্রাটের
উপরেই নয়,ইতিহাস, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর ও বিদ্যমান।
পোস্ট টি লিখেছেন ঃ
রেজওয়ানা আক্তার রিক্তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ